দুর্নীতি মামলার রায় সামনে রেখে নেতাকর্মীদের অভয় দেওয়ার পাশাপাশি যে কোনো বিপদ মোকাবিলায়’ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।তিনি বলেছেন, ‘আমি শুধু বলতে চাই, আমি যেখানে থাকি না কেন, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি।শনিবার ঢাকায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভার উদ্বোধনী অধিবেশনে খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্য আসে। আদালত জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের তারিখ দেওয়ার পর নির্বাহী কমিটির এই সভা ডাকেন বিএনপি নেত্রী। দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা ওই মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামী আগামী ৮ ফেব্র“য়ারি। এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে তার অংশগ্রহণও অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।নির্বাহী কমিটির চার শতাধিক সদস্য এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মন্ডলীর সামনে সভার উদ্বোধনী পর্বে খালেদা জিয়া বলেন, বিপদ এলে সবাই একসাথে মোকাবিলা করব, সুদিন এলেও আমরা সবাই এক সাথে দেশের জন্য কাজ করব। আমাদের সাহস সঞ্চয় করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।খালেদা জিয়া যখন সম্ভাব্য বিপদ’ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, উপস্থিত বিএনপি নোতার তখন স্লোগান দিতে থাকেন- ‘আমার নেত্রী, আমার মা/ জেলে যেতে দেব না, বন্দি হতে দেব না’।আশির দশকে এইচ এম এরশাদের সময়ে গৃহবন্দি হতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। আর ২০০৭-০৮ সময়ের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করার পর সংসদ ভবন এলাকার একটি ভবনকে উপ কারাগার ঘোষণা করে তাকে সেখানে রাখা হয়েছিল।আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে এরশাদের পর খালেদা জিয়া হবেন দুর্নীতির দায়ে দ-িত বাংলাদেশের দ্বিতীয় সরকারপ্রধান।

অবশ্য খালেদা জিয়া ও তার দল দাবি করে আসছে, তিনি দুর্নীতি করেননি এবং তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই আওয়ামী লীগ সরকার ওই ‘মিথ্যা মামলা’ টেনে রায়ের পর্যায়ে এনেছে।খালেদা বলেন, আমাকে কেউ ভয়ভীতি, লোভ দেখিয়ে কিছু করতে পারবে না। অতীতেও পারেনি, এখনো পারবে না। আমি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আছি, আমি দেশের মানুষের সঙ্গে আছি, দেশের মানুষের সঙ্গে থাকব।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খালেদা বলেন, আজ এই নির্বাহী কমিটির সভা থেকে আমি সবাইকে বলব, সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে বহু সন্ত্রাস হবে, ষড়যন্ত্র হবে, নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করা হবে। আমরা কেউ ভয়ে ভীত হব না।নির্বাহী কমিটির সভায় সোয়া এক ঘণ্টার বক্তৃতায় খালেদা বলেন, দেশের নিম্ন আদালত যে ‘সরকারের কব্জায়’, তা ‘সর্বোচ্চ আদালতও’ বলছে।সরকারের কথার বাইরে, ভাবনা চিন্তা যাই থাকুক না কেন, তারা বুঝতে পারছে যে এটা সঠিক নয়, কিন্তু সঠিক রায় দেওয়ার ক্ষমতাটা তাদের নেই।জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদার সঙ্গে তার ছেলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও আসামি। গত এক দশক ধরে তিনি পরিবার নিয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন। মুদ্রা পাচার মামলায় জজ আদালতে খালাস পেলেও হাই কোর্টে তারেককে সাত বছরের সাজা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে খালেদা তার বক্তৃতায় বলেন, সঠিক রায় দিলে যে কি হতে পারে সেটা আপনারা দেখেছেনৃ তারেক রহমানের সঠিক রায় দেওয়া হয়েছে যে আদালতে, সেই বিচারককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ‘সত্যি কথা বলায়’ সরকার তাকে দেশের বাইরে যেতে এবং পদত্যাগ করতে ‘বাধ্য করেছে’ বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।সরকারকে প্রতিহিংসার রাজনীতি’ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে খালেদা বলেন, ‘‘হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি বন্ধ করে দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন। আমরা কখনো প্রতিহিংসা করব না। সেই সঙ্গে সরকারকে এই বলে তিনি হুঁশিয়ার করেন যে, এভাবে বেশি দিন যাওয়া যায় না; পৃথিবী বহু দেশে বহু শক্তিশালী নেতা এসেছেন, কারও ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়।আজকে তারা কোথায়? ৃ যাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল, তাদের অনেকে কিন্তু দুনিয়ায় নেই। কাজেই এটা বুঝতে হবে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।উদ্বোধনী পর্বে ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার আদালতে দেয়া জবানবন্দি’ নামের একটি পুস্তিকা দেওয়া হয়। জিয়া এতিখানা ট্রাস্ট মামলার বিবরণ ও আইনজীবীদের শুনানি এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতে খালেদার দেওয়া বক্তব্য নিয়েই ৪০ পৃষ্ঠার এ পুস্তিকা।নির্বাহী কমিটির সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন খালেদা জিয়ানির্বাহী কমিটির সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন খালেদা জিয়াবিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির কোনো ভয় নেই। বিএনপির সঙ্গে প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে, সশস্ত্র বাহিনী আছে। এ দেশের জনগণ আছে। দেশের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা আছেন। কাজেই বিএনপির কোনো ভয় নেই, ভয়টা আওয়ামী লীগের।

খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকার প্রশাসনকে দলীয় নেতা-কর্মীদের মতো ব্যবহার করছে। তারা মনে করে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া যায়। কিন্তু প্রশাসন যদি একটু সুযোগ পায়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। কেননা, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। তিনি আরও বলেন, পুলিশকে বাধ্য করা হচ্ছে অন্যায় ও দলীয় কাজ করতে।বক্তব্যের শেষে এসে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আমাকে কোনো ভয়ভীতি দেখিয়ে দমাতে পারেনি, পারবেও না। আমি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আছি, দেশের মানুষের সঙ্গে আছি । খালেদা জিয়া বলেন, ‘সাহস সঞ্চার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আসুন, সবাই এই দেশটাকে রক্ষা করি, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনি।সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘গুম, খুনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ জেগে উঠবে, ২০ দল জেগে উঠবে। সকল রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। আজ দেশের এই অবস্থায় জাতীয় ঐক্য অনেক বেশি প্রয়োজন। আমরা কে কী পেলাম, সেটা বড় কথা নয়। আমাদের পাওয়া ওটাই হবে, যদি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দেশটাকে রক্ষা করতে পারি, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় পাওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ দেশ জাগবে, জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে। সকলেই আমরা দেশ গড়ে তুলব। দেশ গড়ার জন্য অনেক লোকের প্রয়োজন হবে। সেখানে আজ যারা জুলুম-অত্যাচার করছে, তাদের সবাইকে মাফ করে দিয়েছি। আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না, তাদেরও সঙ্গে নিতে আমরা কোনো দ্বিধা করব না।

খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। বহু সংকট আসবে, ষড়যন্ত্র হবে এবং নানা রকমভাবে ভয়ভীতি দেখাবার চেষ্টা করবে, কিন্তু আমরা ভয়ে ভিতু নই।বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘যারা সকল আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল, যারা কাজ করেছে, যারা দলের সঙ্গে বেইমানি করেনি, দলে তাদের ভালো ভালো জায়গায় অবস্থান দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অবশ্যই তারা মূল্যায়ন পাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু যারা বেইমানি করবে, এক পা এদিকে, আরেক পা ওদিকে রাখবে, তাদের কোনো মূল্যায়নের জায়গা নেই।আগে ক্ষমা করার উদাহরণ টেনে খালেদা জিয়া বলেন, ‘তারপরও আমরা কিন্তু ক্ষমা করেছি। ক্ষমা একবার হয়, বারবার হয় না। তাই আমি বলতে চাই, বিপদ আসলে আসুন সকলে একসঙ্গে বিপদ মোকাবিলা করব। আর সুদিন আসলে একসঙ্গে সুন্দর করে দেশ গড়ব।’খালদো জিয়া বলেন, দেশের ক্রান্তিকাল চলছে। আমরা এখানে সভা করতে চাইনি। ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, সোহরাওয়ার্দী ছিল, কিন্তু কেন সভা করতে দেওয়া হলো না। বিএনপি সবচেয়ে বড় দল। তারপরও বলবেন দেশে গণতন্ত্র আছে?’ তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল আইনের নামে নতুন কালাকানুন করা হচ্ছে। সাংবাদিকেরা সত্য কথা বলেন। সেই কথাগুলো যখন মানুষ শোনে, তখন জনগণের অধিকার হরণ করতে নতুন আইন করা হচ্ছে।খালেদা জিয়া বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত বলছেন নিম্ন আদালত সরকারের কবজায়। পত্রিকায় যা দেখছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে, সঠিক রায় দেওয়ার সুযোগ নেই। সঠিক রায় দিলে কী পরিণতি হয়, তা তো দেখেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারেক রহমানের রায় দেওয়ার পর বিচারককে দেশ ছাড়তে হয়েছে। অপরাধ নেই। সেখানে কীসের বিচার হবে। কিন্তু তারা জোর করে বিচার করতে চায়।খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সময় মিলনায়তনে উপস্থিত নির্বাহী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান দেন। নেতারা স্লোগানে বলেন, ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দী হতে দেব না।’ ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে যেতে দেব না।আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারের সমালোচনা করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বলছে নির্বাচন হবে ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে এত আগে প্রচারের কারণ কী? তিনি বলেন, ‘নৌকা এমন ডোবা ডুবছে, যে তোলার জন্য এত আগে ভোট চাইতে হচ্ছে? হাত তুলে ওয়াদা করাতে হচ্ছে।’এর আগে ১১টা ৩৮ মিনিটে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ধারণকৃত একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়।এর আগে উদ্বোধনী পর্বে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া দলের পক্ষ থেকে শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় প্রয়াত নেতাদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ-শিল্পী-সাহিত্যিকসহ বিশিষ্টজনদের স্মরণ করে দেওয়া শোকপ্রস্তাবটি গৃহীত হয়।