এবার পুকুরের মিঠা পানিতেও ইলিশ চাষের স্বপ্ন দেখছেন গবেষকরা। গবেষকরা এরই মধ্যে ইলিশের জীবনের গতিপথ ও বিচরণের রহস্য উন্মোচন করেছেন। আর এর মাধ্যমে জানা যাবে, কীভাবে ইলিশের স্বাদ ঠিক রেখে সব গুণাগুণসহ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এই গবেষণার পর গবেষকরা পুকুরে ইলিশ চাষের স্বপ্ন দেখছেন।সম্প্রতি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষকরা এ দাবি করেছেন। জিনোম সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যাসেম্বলি টিমের সমন্বয়ক ও বাকৃবির ফিসারিজ বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলমের মতে, গবেষণায় যে তথ্য পাওয়া গেছে, তারই আলোকে এখনই পুকুরে ইলিশ চাষের স্বপ্ন দেখা ভুল হবে।

জিনোম সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যাসেম্বলি টিমের সমন্বয়ক ও বাকৃবির ফিসারিজ বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন আমরা যে গবেষণা করেছি, তা যদি প্রয়োগ করা না হয় তাহলে মানুষের কোনও কাজে আসবে না। তবে আমরা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট হয়েছি, আমাদের গবেষণায় পাওয়া তথ্য প্র্যাকটিক্যালি যদি অ্যাপ্লাই করা যায়, তাহলে স্বাদ ও মান ঠিক রেখে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। যেমন, নদীতে যেক’টি অভয়াশ্রমে ইলিশ বিচরণ করে, সেখানে বর্তমান পরিবেশে যেসব খাদ্য উপাদানের কারণে ইলিশ উৎপাদিত হয়, সেসবের ব্যবহার করে এই মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।।তিনি আরও বলেন, এই অভয়াশ্রমগুলোকে আরও বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নতিকরণের মধ্য দিয়ে মাছের উৎপাদন করা সম্ভব, সেটা এখন বলা সম্ভব। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, এই গবেষণার মাধ্যমে ইলিশ পুকুরেও চাষ করা সম্ভব, তাহলে সেটা ভুল হবে। কারণ, ইলিশ সমুদ্র ও নদী দুই জায়গাতেই আশ্রয় নেয়, ডিম পাড়ে বড় হয়। তার বাসস্থান সেখানেই, তাকে সেখানেই মানায়। তবে পুকুরে চাষ করা সম্ভব কিনা, এটা এখনই বলা যাবে না। এর জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন। আমরা সে চেষ্টা করতে পারি।ইলিশের জিনোম বিন্যাস উদঘাটনে পৃথক একটি গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, গবেষণা তো মাত্র শুরু। এখনও অনেক পথ এগোতে হবে। এখন শুধু আমরা একটি রেফারেন্স উদঘাটন করেছি। এখন যে তথ্য পেয়েছি, ইলিশ কোন পরিবেশে কীভাবে বসবাস করে, কোন ধরনের পরিবর্তনের কারণে তার স্বাদ পাল্টায়, কোন পরিবর্তনের জন্য তার উৎপাদন বৃদ্ধি বা হ্রাস হয়, এগুলো আমরা খুঁজে বের করেছি। এরপর এই সূত্রগুলো ব্যবহার করে পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত পদ্ধতি খুঁজে বের করবো। মাছকে কোন পরিবেশ দিতে পারলে তার উৎপাদন বাড়বে এবং স্বাদ নষ্ট হবে না, তা আবিষ্কারের চেষ্টা করবো। তিনি আরও বলেন, মিষ্টি পানিতে মাছ যখন যায়, তখন সে কোন প্রোটিন তৈরি করে, আবার সেই একই মাছ লোনা পানিতে গেলে কোন প্রোটিন তৈরি করে, কোন প্রোটিন তাকে দেওয়ার প্রয়োজন, কোন প্রোটিন পেলে মাছটি মিষ্টি পানিতেই থাকতে পারবে, আমরা তা অনুসন্ধান করছি। এসব তথ্য জানা গেলে পুকুরে ইলিশ চাষ সম্ভব কিনা, তাও জানতে পারবো।

প্রসঙ্গত, বিশ্বে প্রথমবারের মতো ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে । বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলমের নেতৃত্বে এ গবেষণা করা হয়। ইলিশের ভৌগোলিক স্বীকৃতি বা জিআই পাওয়ার পর দেশীয় ইলিশের রেফারেন্স জিনোম প্রস্তুতকরণ, জিনোমিক ডাটাবেজ স্থাপন এবং মোট জিনের সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গবেষণা শুরু করেন বাকৃবির ওই গবেষকরা। তারই ফলশ্র“তিতে বিশ্বে প্রথমবারের মতো উন্মোচিত হলো ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য।৮ সেপ্টেম্বও সকাল ৯টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানান পূর্ণাঙ্গ ইলিশ জিনোম সিকোয়েন্সিং ও অ্যাসেম্বলি টিমের সমন্বয়ক ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম।তিনি বলেন, জিনোম হচ্ছে কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ সব জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোম দ্বারা। ইলিশের জিনোমে ৭৬ লাখ ৮০ হাজার নিউক্লিওটাইড রয়েছে, যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক চতুর্থাংশ। ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স জানার মাধ্যমে অসংখ্য অজানা প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে খুব সহজেই। বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের স্টকের সংখ্যা (একটি এলাকায় মাছের বিস্তৃতির পরিসীমা) কতটি এবং দেশের পদ্মা, মেঘনা নদীর মোহনায় প্র জননকারী ইলিশগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্টক কিনা তা জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সর মাধ্যমে।বছরে দুইবার ইলিশ প্রজনন করে থাকে। জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে এই দুই সময়ের ইলিশ জিনগতভাবে আলাদা কিনা তা জানা যাবে। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট নদীতে জন্ম নেওয়া পোনা সাগরে যাওয়ার পর বড় হয়ে প্রজননের জন্য আবার একই নদীতেই ফিরে আসে কিনা সেসব তথ্যও জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে।

তিনি আরও বলেন, এরকম নতুন নতুন তথ্য উন্মোচনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাবে ইলিশের টেকসই আহরণ। ইলিশের জন্য দেশের কোথায় কোথায় ও কতটি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা সহজ হবে। দেশীয় ইলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের (ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য) ইলিশ থেকে জীনতাত্ত্বিকভাবে স্বতন্ত্র কিনা তাও নিশ্চত হওয়া যাবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গবেষণা কাজ শুরু করেন তারা। ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি- নোভো জিনোম অ্যাসেম্বলি প্রস্তুত হয়। ওই বছরের ২৫ আগস্ট ইলিশের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স আন্তর্জাতিক জিনোম ডাটাবেজ ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনে (এনসিবিআই) জমা করা হয়। এছাড়াও ইলিশের জিনোম বিষয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল ২টি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সেও উপস্থাপন করা হয়েছে।পূর্ণাঙ্গ ইলিশ জিনোম সিকোয়েন্সিং ও অ্যাসেম্বলি টিমের সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম এবং সদস্য হিসেবে ছিলেন পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা, বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ গোলাম কাদের খান। জাতীয় মাছ ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং এর গবেষণা কাজটি গবেষকদের নিজস্ব উদ্যোগ, শ্রম এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়েছে। এ গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলদেশের মৎস্য সেক্টর পূর্ণাঙ্গ জিনোম গবেষণার যুগে প্রবেশ করেছে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।