জোড়া মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করা রাবেয়া-রোকাইয়ার সফল অস্ত্রোপচার শেষে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে বাবা-মায়ের কোলে ফিরে গেল। এই দুরূহ কাজটির জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা সত্যিই খুব আনন্দের, একটি অন্যরকম অনুভূতি। আজকে রাবেয়া-রোকাইয়া বাড়ি ফিরে যাবে। তার বাবা-মার কোলে হেসেখেলে বেড়াবে এটা সত্যি খুব বড় পাওয়া। আমরা মুজিব বর্ষ পালন করছি, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই বছরের সেই সময় এত বড় একটা সফল অস্ত্রোপচার করা এবং সফলতা অর্জন করা বাংলাদেশের জন্য অনেক বিরাট অর্জন।

রোববার (১৪ মার্চ) দুপুরে জোড়া মাথাবিশিষ্ট যমজ শিশু রাবেয়া ও রোকাইয়ার সফল চিকিৎসা শেষে মুজিব শতবর্ষে গৃহ প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকার প্রধান একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন।

২০১৬ সালের ১৬ জুলাই পাবনার চাটমোহরের আটলংকা গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুন দম্পতির ঘরে জোড়া মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে জমজ শিশু রাবেয়া-রোকাইয়া। প্রতি পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন শিশুর মধ্যে একজনের এ ধরনের বিরল রোগ হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটিকে ‘ক্রেনিয় পেগাজ’ বলে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাবেয়া ও রোকাইয়ার কথাটি আমাকে জানায় আমার ছোট বোন রেহেনা। সে পত্রিকায় এটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটা মেসেজ দিলো যে তুমি দেখো এরকম দুটো বাচ্চা কি করা যায়? এর চিকিৎসার জন্য কিছু করা যায় কিনা। আমি সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিলাম। আমি সত্যিই খুব আনন্দিত যে এতো দীর্ঘ চিকিৎসার পর রাবেয়া-রোকাইয়ার সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। যে মার্চ মাস বাঙালির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসেই আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছেন। এ মাসেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আবার এই মাস থেকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। এটা সত্যিই খুব আনন্দের, অন্যরকম একটি অনুভূতি।

তিনি বলেন, এই চিকিৎসাটা যখন শুরু হলো, আমরা দেখেছি কিভাবে প্রত্যেকের ভেতরে একটা আগ্রহ। সব থেকে ভালো লাগলো যে ডাক্তার নার্স থেকে শুরু করে টেকনেশিয়ান প্রত্যেকের একটা আলাদা সহানুভূতিশীল মনোভাব ছিল। বিশেষ করে হাঙ্গেরিয়ান একটা গ্রুপ। হাঙ্গেরিয়ান দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেন্স পিপল ফাউন্ডেশন (এডিপিএফ)। এই ফাউন্ডেশনের খবরটা দিয়েছিল জার্মানিতে আওয়ামী লীগ করে আমাদের হাসনাত মিয়া। হাসনাত এই ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত। এখানে কিছু জার্মানির ডাক্তার, হাঙ্গেরিয়ান ডাক্তার এবং বিভিন্ন সোশ্যাল ওয়ার্কার তাদের নিয়ে আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নামে যে হাসপাতালটা করেছে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে। সেই হাসপাতাল তারা ভিজিট করতে এসেছিল, আমাদের এখানে কিছুদিন ট্রেনিং দিতে এসেছিল। তারা যখন এ ধরনের একটা ঘটনা শুনলো তারাও আগ্রহ প্রকাশ করল তখনই রাবেয়া-রোকাইয়াকে আনা হলো।

তিনি আরও বলেন, রাবেয়া-রোকাইয়াকে হাঙ্গেরি পাঠালাম, হাঙ্গেরিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে আমি মেসেজ দিলাম এবং আমি নিজেও যখন হাঙ্গেরি যাই তখন কথা বলেছিলাম। দীর্ঘদিন রাবেয়া-রোকেয়ার ওখানে চিকিৎসা হয়। প্রায় ৪৮টা অপারেশন হয়েছে। যেটা চিন্তাও করা যায় না। যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুব কম দেখা যায়। পরবর্তীতে ঠিক যখন আলাদাটা হবে তখন কোথায় হবে সেটা নিয়ে একটু কথা হচ্ছিলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে না আমরা সিএমএইচে করব। উদ্দেশ্য হলো এখানে আমাদের যারা ডাক্তার বা যারা এখানে কাজ করবে তাদের একটা অভিজ্ঞতা হবে। সেভাবে অপারেশন থিয়েটার সবকিছু তৈরি করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩৩ ঘণ্টা একটানা অপারেশন করেছে এটা বিরাট ব্যাপার। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সবাই কাজ করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা পারদর্শী তাদেরকে একত্র করা হয়েছে যাতে কোনরকম কোথাও এতটুকু ফাঁক না থাকে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার যে রাবেয়া-রোকাইয়া জোড়া মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এ ধরনের ঘটনা মাঝে মাঝে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এই জোড়াটাকে আলাদা করা এটা একটা সম্পূর্ণ নতুন কাজ। আজকে রাবেয়া-রোকেয়া বাড়ি ফিরে যাবে। তার বাবা-মার কোলে হেসেখেলে বেড়াবে এটা সত্যি খুব বড় পাওয়া।

তিনি রাবেয়া-রোকাইয়ার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে বলেন, আপানার দোয়া করবেন। তারা যেন সুস্থ থাকে, ভালো থাকে এবং বাবা-মার বুকে আনন্দ নিয়ে আসতে পারে। রাবেয়া ও রোকাইয়ার সার্বিক সুস্থতা এবং সুন্দর জীবন কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। মুজিববর্ষে রাবেয়া-রোকাইয়ার শুভ গৃহ প্রত্যাবর্তন এটা সবার জন্য আনন্দ এবং গর্বের।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট ৩৩ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারে মাথা জোড়া লাগানো যমজ শিশু রাবেয়া-রোকাইয়াকে সফলভাবে পৃথক করা হয়। রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এ অস্ত্রোপচার হয়। এতো দিন সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিল শিশু দুটি।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের এই কন্যা শিশুদের ২০১৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এখানে দুই স্তরে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত জানুয়ারিতে শিশু দুটিকে হাঙ্গেরি পাঠানো হয়। সেখানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৮টি অস্ত্রোপচার করা হয়।

২০১৭ সাল থেকে এ শিশু দুটির চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাঙ্গেরি সরকারের মাধ্যমে হাঙ্গেরিয়ান দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেন্স পিপল ফাউন্ডেশন (এডিপিএফ) চিকিৎসায় সক্রিয় সহায়তা করেছে।