দেশে এখন গণতান্ত্রিক সরকার নেই,চলছে পুলিশ স্টেট

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকার যদি অবলম্বে নির্বাচন না দেয় তবে জনগণ রাজপথে নেমে তা আদায় করবে। তখন আর সরকারের পালাবার পথ থাকবে না। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লন্ডন সফররত খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এর আগে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ছেলের বৌ জোবায়দা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু করেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। বাঙালি অধ্যূষিত টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকা থেকে দূরে ইলফোর্ডের ফেয়ারলপ ওয়াটার কাউন্টি পার্কের একটি হলে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে এ শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু হয়।

অনুষ্ঠান শুরুর পরপরই কর্মীদের চরম হুড়োহুড়ি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে বারবার বন্ধ করতে শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই অনুষ্ঠান। স্থানীয় সময় বেলা ৫টায় অনুষ্ঠান মঞ্চে আসার কথা থাকলেও তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমানকে নিয়ে খালেদা উপস্থিত হন সন্ধ্যা ৭টায়। এ সময় মঞ্চে ফুল দিয়ে নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু করেন। কিন্তু কার আগে কে দেবে এই প্র্রতিযোগিতায় শুরু হয় হুলস্তুল কাণ্ড। মঞ্চে শুধু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান থাকার কথা থাকলেও হুড়মুড় করে নেতা-কর্মীদের অনেকেই উঠে যান। এতে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে পুরো শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব। মূলত যুক্তরাজ্য বিএনপির বিবদমান দু’গ্র“পের রেশারেশির কারণে এঘটনা ঘটেছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। বিশৃঙ্খলা বন্ধ করার জন্যে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাইকে বারবার অনুরোধ জানালেও কেউই তার কথায় কর্ণপাত করছিলেন না। এমন অবস্থায় কর্মীদের হাত থেকে ফুল গ্রহণ কয়েকবারই বন্ধ করতে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় শেষ পরযন্ত ক্ষুব্ধ দিলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে শুভেচ্ছা বিনিময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের বিরুদ্ধে হত্যা, গুম ও বিএনপি নেতাদের হয়রানির অভিযোগ তুলে খালেদা জিয়া বলেন, শেখ হাসিনা জানেন নির্বাচন দিলে তার দল পরাজিত হবে এবং ক্ষমতাচ্যুত হলে নিজের পরিবারের দুর্নীতির কারণে পার পাবেন না। আর একারণেই নির্বাচন দিচ্ছেন না তিনি। ক্ষমতায় গেলে এসব দুর্নীতি, হত্যা ও গুমের বিচার হবে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ধৈর্য ধরে এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যান, সবকিছুরই হিসেব নেওয়া হবে। শেখ হাসিনার সরকার পদ্মাসেতু করতে পারবে না দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক এই সেতুর প্রজেক্ট থেকে সরে গিয়েছে, এই সরকার পদ্মাসেতু করতে পারবেনা।বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দু’টো পদ্মাসেতু করা হবে,’ ঘোষণা দেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশে মানুষের কোনো মৌলিক অধিকার নেই, মানবাধিকার নেই, আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র নেই। বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মীদের ওপর বিশ থেকে একশটির মতো মামলা রয়েছে। এই হল বাংলাদেশ। যেখানে মানুষ ঠিক মত ঘুমাতে পারে না। শেখ হাসিনার সরকারকে অবৈধ ও অনির্বাচিত একটি সরকার উল্লেখ করে বেগম জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিতে কেন্দ্রে যায়নি, ভোট কেন্দ্রগুলো ছিলো ফাঁকা। নির্বাচনের আগেই ১৫৪ জনকে বিনাভোটে এমপি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। বিনাভোটের এই সরকারকে জনগণ বৈধ বলে মেনে নেয়নি। তারা গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে আছে। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, সরকার আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধানকে পরিবর্তন করে নিজেদের মতো করেছে। দেশে সেই বাকশালের মতো অবস্থা চলছে। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচন, মেয়র নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভই প্রমাণ করে জনগণ বিএনপির পেছনে ঐক্যবদ্ধ। তাই তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে চায় না। নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছাড়লে সরকার পার পাবে না। খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশে বিরোধী দল ও মতের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের মাধ্যমে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কাউকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একদিন রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হবে। দেশে সংবাদপত্রের কোনো স্বাধীনতা নেই উল্লেখ করে বেগম জিয়া বলেন, সাংবাদিকরা সত্যি কথা লিখতে পারে না। সত্যি কথা লিখলে তাদের নামে মামলা হয়, জেল হয়। যারা টকশো-তে সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা করে তাদেরকে টকশো-তে আসতে দেয়া হয় না। সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে বিরোধী দলের কিছু প্রচার করতে দেয়া হয় না। তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এতে তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় আতংক হলো খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। কিছু হলেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম। একদলীয় পার্লামেন্টে বসে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও জিয়াউর রহমানকে গালিগালাজ করা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। বেগম জিয়া বলেন, বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে, দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে। প্রতি মুহর্তে দেশের মানুষ খুন ও গুম হচ্ছে। চলছে অত্যাচার, অনাচার আর গুমনীতি। কোনো উন্নয়ন নেই। দেশের মানুষ এসবের পরিবর্তন চায়। চায় শান্তি, উন্নয়ন ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। এই সরকারের পক্ষে পদ্মা সেতু করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, নিরপেক্ষ র্নিবাচন হলে বাংলাদেশের জনগণ বিএনপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে। আর বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ইনশাল্লাহ পদ্মা ে সেতু তৈরী করবে। বাংলাদেশকে বাঁচাতে সকলের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে উল্লেখ বেগম জিয়া বলেন, বিএনপি শান্তি উন্নয়ন গণতন্ত্র ও জনগণের কল্যাণে বিশ্বাস করে। তাই আমরা জাতিকে বিভক্ত করে নয়, বরং ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে চাই। যাতে বৃটেনের মতো নিরপেক্ষ ভোট হবে। আর এই ভোটে জনগণ যাকে নির্বাচিত করবে সেইও হবে জনগণের প্রতিনিধি। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে জয়ের মধ্যে কোনো শান্তি নেই, কোনো আনন্দ নেই। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আমরা সবাইকে নিয়ে শান্তি ঐক্য ও উন্নয়নের রাজনীতি করতে চাই। আওয়ামী লীগের মধ্যেও ভালো ও দেশপ্রেমিক লোক আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের সঙ্গে নিয়েই তিনি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, গণতন্ত্র না থাকলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও শিক্ষার ওপর ভ্যাটের সমালোচনা করে বেগম জিয়া বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনের মূখে সরকার ভ্যাট প্রতাহার করতে বাধ্য হয়েছে। দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বেগম জিয়া বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একসময় দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে। বাংলাদেশের মানুষ দেশে পরিবর্তন দেখতে চায়, গণতন্ত্র দেখতে চায়, মানবাধিকার মৌলিক অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চায়।

চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে বক্তব্যের শুরুতেই খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের যুক্তরাজ্যের সভ্য পরিবেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তারা যেন শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনটুকু বোঝেন। তিনি প্রায় ২৫ মিনিট বক্তব্য দেন।শেখ হাসিনা সরকারের কড়া সমালোচনা করে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, দেশে বর্তমানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, আইনের শাসন কিংবা গণতন্ত্র কোনোটাই নেই। আদালতগুলোতে আওয়ামী লীগের লোক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাক্ষী প্রমাণ যাই থাকুক আওয়ামী লীগ যা বলছে সেটাই বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।বিরোধী দলগুলোকে এখন মানববন্ধন, মৌন মিছিল, সমাবেশ এমনকি হলের ভেতরেও কোনো সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, পুলিশ নিজেরাই বলে যে তারা এই সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। কাজেই এটা পুলিশ স্টেট হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক সরকার নেই, পুলিশ স্টেট। পুলিশরা এখন যা ইচ্ছা তাই করছে। আওয়ামী লীগের যারা পুরোনো জ্যেষ্ঠ নেতা-কর্মী তাঁরাও পাত্তা পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন খালেদা জিয়া।

খালেদা উপস্থিত নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন করে বলেন, ‘আপনাদের মনে আছে বাকশাল? সেই বাকশালের মতো অবস্থা করে ফেলেছে দেশে। তিনি বলেন, দেশে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ নিরাপদ নয়। এই অবস্থা আগে কখনো ছিল না। হাসিনার এগেইনস্টে কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। হাসিনা যে মিথ্যা কথা বলছে, অন্যায় করছে তার জবাবও কেউ দিতে পারবে না। বাংলাদেশ এখন কঠিন সময় পার করছে। জনগণ এই সরকার থেকে মুক্তি চায় ।সরকার গায়ের জোরে টিকে আছে উল্লেখ করে খালেদা বলেন, আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধানকে নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হাসিনা গদি ছাড়বেন না। কারণ তারা এত চুরি, লুটপাট, দুর্নীতি করেছে যে তারা পার পাবেন না’। কারও নাম উল্লেখ না করেই খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে কিছু পরগাছাও বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছে। যারা কোনো নির্বাচনে জামানতও রক্ষা করতে পারে নাই।