রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরের ডিসিসি বা ডিএনসিসি মার্কেটে লাগা আগুন এখনো নেভেনি। বেলা আড়াইটার সময় মার্কেটের যে অংশে গতকাল সোমবার রাতে আগুন লাগে, সেই অংশে আগুন জ¦লতে দেখা যাচ্ছে। সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে এই মার্কেটে আগুন লাগে। আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটা পর্যন্ত আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি।ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাঁদের উচ্ছেদের জন্য চক্রান্ত করে আগুন দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এই ঘটনাকে নাশকতা বলে মনে করছেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার সার্ভিস তেমনভাবে কাজ করছে না। দোতলা একটি বিল্ডিংয়ের ওপর এই মার্কেট, চারপাশে খোলা অথচ ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে ক্ষোভ জানান তাঁরা।

মার্কেট মালিক সমিতির চেয়ারম্যান শের মোহাম্মদ দাবি করেন, ২০০৩ সালে মেট্রো গ্র“পের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুয়ায়ী এই মার্কেটটি ভেঙে এখানে ১৮তলা-বিশিষ্ট একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু এখানকার দোকানমালিকদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এই নিয়ে দোকানমালিকদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একরকম বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। বহুবার তাঁদের উচ্ছেদের জন্য হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ২০১০ সালে একটি মামলাও হয়েছে। বর্তমান মেয়র আনিসুল হক দায়িত্ব নেওয়ার পর দোকানমালিকদের কোনো হুমকি না দিয়ে বিষয়টি সমঝোতার চেষ্টা করেন। শের মোহাম্মদের দাবি, এটি নিশ্চিত নাশকতা, তাই আগুন লাগার আধা ঘণ্টার মধ্যে ভবনের একাংশ ধসে পড়েছে। সাধারণত আগুন লাগলে এভাবে বিল্ডিং ধসে পড়ে না।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মতৎপরতা নিয়ে অভিযোগ তোলেন মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বহু দোকানমালিক। তাঁদের মধ্যে আলতাফ হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ষড়যন্ত্র মূলকভাবে আমাদের উচ্ছেদের জন্যই আগুন দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাতে মার্কেটের পূর্ব অংশে আগুন লাগে এবং কিছু সময় পর ওই অংশটি ধসে পড়ে। সকাল সাতটা পর্যন্ত মার্কেটের পশ্চিম অংশে কোনো আগুন ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের উপস্থিতিতেই আগুন পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সারা মার্কেটে ছড়িয়ে পড়েছে।কাপড় ব্যবসায়ী মনসুর আলী জানান, ফায়ার সার্ভিসের ২০-২১টি ইউনিট কাজ করছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একসঙ্গে দুটি বা তিনটির বেশি কাজ করছে না। একটি ইউনিট ১০ মিনিটের জন্য পানি দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার ১০ মিনিট পর পানি নিয়ে আসছে। এই সময়ের মধ্যে আগুন আবার ছড়িয়ে পড়ছে। নিয়ন্ত্রণে আসছে না।এদিকে দুপুরে আবারও ঘটনাস্থলে আসেন মেয়র আনিসুল হক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভবনে কোনা মানুষ চাপা পড়েনি, এটা আল্লাহর রহমত।

আগুন পরিকল্পিতÑব্যবসায়ীদের এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মালিকেরা জানেন, আমি জানি না।’আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে উলে।লখ করে আনিসুল হক বলেন, দু-একটি জায়গায় এখনো আগুনের ফুলকি দেখা গেছে। আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস কাজ করবে। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে বলা যাবে না আগুন নিয়ন্ত্রণে।ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আসুক, তাঁদের সঙ্গে বসব। রাজধানীর গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের ভয়াবহ আগুন কোটি কোটি টাকার মালামাল পুড়িয়ে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে ব্যবসায়ীদের।

উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেক ব্যবসায়ীর। সোমবার রাত ২টার পর ছড়িয়ে পড়া ওই আগুন নেভাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। মঙ্গলবার দুপুরেও মার্কেটের ভেতরে আগুন জ¦লছিল; ধসে পড়েছে মার্কেটে একাংশ।সকালে ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়ে মার্কেট চত্বরের সামনে কাঁদতে দেখা গেছে অনেক ব্যবসায়ীকে; চোখের সামনে নিজে দোকানের জিনিসপত্র পুড়তে দেখা এই ব্যবসায়ীরা তাদের শোক, ক্ষোভ, উত্তেজনা ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। আকস্মিক এই বিশাল ক্ষতি কীভাবে সামলে উঠবেন তা নিয়ে ভাবতেও পারছেন না তারা।

আনোয়ার হোসেন (৩৫) নামে ব্যবসায়ী বলেন, তার বাবা ১৯৭২ সাল থেকে এই মার্কেটে ব্যবসা শুরু করেন। মার্কেটে তাদের তিনটি খাবারের দোকান ছিল, যার সবগুলোই পুড়ে ছাই।গতকালও আমি কোটিপতি ছিলাম। এখন রাস্তার ফকির।ডিসিসি (পাকা) মার্কেটের ১২১ নম্বর দোকানটিতে কার্পেটের দোকান ছিল ষাটোর্ধ্ব বাবর আলীর। দোকানে প্রায় ২৫ লাখ টাকার কার্পেট ও থান কাপড় ছিল বলে জানান তিনি।পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কী বলব বাবা, আমার সব তো শেষ। কিছু মাল বের করতে পারছি, বেশির ভাগ মালই রয়ে গেছে।আগুন বাড়তাছে। কী জানি হয়? ছেলেরা ধোঁয়ার জন্য মালামাল বের করতে পারছে না।এই মার্কেটের ১০১ নম্বর দোকানের বাই-সাইকেল ব্যবসায়ী আবু ইউসুফ জনি হতাশ কণ্ঠে বলেন, মালামাল বের করার চেষ্টা করতেছি, কিন্তু ধোঁয়ার জন্য পারতেছি না।

২০ বছর আগে নোয়াখালী থেকে খালি হাতে ঢাকায় এসেছিলেন মো. রাসেল (৩২)। পড়াশোনা ও ঢাকায় থাকার খরচ চালিয়েছেন টিউশনি করে। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় ৫৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে প্রসাধনীর দোকান দিয়েছিলেন তিনি।ভেঙে পড়া কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার একমাত্র মেয়েকে এই বছর স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। তাকে যে আগামীকাল স্কুলে পাঠাব তার রিকশা ভাড়াও আমার কাছে নাই।এখানে বড় বড় লোকজন আসছে, মিডিয়ার সামনে কথা বলছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।

দুদিন আগেই নতুন মাল কিনে দোকানে তুলেছিলেন খেলনা বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন।তিন সন্তানের জনক এই ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, (দোকান থেকে) একটা সুতাও বের করতে পারি নাই। সব জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।এই মার্কেটটা ঘিরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হত। সবার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।আগুন লাগার পর রাতের নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে খবর পেয়ে অনেক দোকান মালিকই তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। ওই যতটুকু সম্ভব কর্মচারীদের সহায়তায় কেউ কেউ নিজেদের মালামালও সরিয়েছেন।সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, দোকানিরা পলিথিনের বস্তায়, কাঠের বাক্সে বা মোটা কার্টনে আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেটের ভেতরের দোকান থেকে তাদের পণ্য বের করে আনছেন।

অনেককেই উত্তেজিত দেখা যায়; কেউ কেউ এক জায়গায় নিজের দোকানের পণ্য জড়ো করছিলেন আর চোখের পানি মুছছিলেন।মার্কেটের সামনের যানবাহন পার্কিংয়ের জায়গায় আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া পণ্যগুলো জড়ো করলেও সেখানে অগ্নিনির্বাপনের পানি জমতে থাকায় ট্রাকে বা রিকশা ভ্যানে করে তা সরিয়ে নেন। যারা তাদের পণ্য সরানোর জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারেন নাই, তারা পাশের ফুটপাথে তা নিয়ে জড়ো করছিলেন।এদেরই একজন প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসায়ী মনসুর ফায়ার সার্ভিসের কাজে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ঝাড়লেন।তিনি বললেন, রাতে ফায়ার সার্ভিস ঠিকমতো কাজ করেনি, তাদের গাফিলতি ছিল। তারা যদি রাতেই তৎপর হতো তাহলে এই অবস্থা হতো না। ডিসিসি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এস এম তালাল রিজভী বলেন, রাত আড়াইটার দিকে মার্কেটে আগুন লেগেছে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসি। তখন ফায়ার সার্ভিসের মাত্র দুটি ইউনিট এসেছিল। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটের স্বল্পতার কারণে দুই মার্কেটই আগুনে ঝলসে গিয়েছে। ভোর ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আগে বাড়ালে ক্ষতি এতো হতো না।এখানে পাকা ও কাঁচা দুটি মার্কেট ছিল, আগুন লেগেছিল কাঁচা মার্কেটে। আমাদেরটা হলো পাকা মার্কেট। ভোর পর্যন্ত আমাদের এখানে আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি ছিল। আমাদের এখানে কাঁচা-পাকা মিলিয়ে ৬০৫টি দোকান রয়েছে।দুই মার্কেটে কমপক্ষে দেড়শো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন রিজভী।