পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিয়েই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাণিজ্িযক এলাকা থেকে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ, মিছিল ও সমাবেশ করেছে হকারদের বিভিন্ন সংগঠন।মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হকারদের ১৬ সংগঠনের জোট হকার সমন্বয় পরিষদ এর এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে হকারদের জন্য পুনর্বাসন নীতিমালা তৈরির দাবি জানানো হয়েছে।

গত দুই দিনে গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদ জানিয়ে পরিষদের সমন্বয়ক আবুল হোসেন বলেন, মেয়র সাঈদ খোকন তুঘলকি পদক্ষেপ’নিয়েছেন।এর ফল ভালো হবে না। আপনার পিতাও এই নগরের মেয়র ছিলেন। তিনি কখনও হকারদের উচ্ছেদ করনেনি। আশা করি আপনিও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন না।গত ১১ জানুয়ারি নগর ভবনে এক বৈঠক শেষে মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন, রোববার থেকে সাপ্তাহিক কোনো কর্মদিবসে আর গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকায় দিনের বেলায় ফুটপাতে হকার বসতে দেওয়া হবে না। হকাররা দোকান নিয়ে বসতে পারবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরে। তবে ছুটির দিনে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।

এরপর রবি ও সোমবার সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গুলিস্তান,বায়তুল মোকাররম, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকায় চালানো হয় হকার উচ্ছেদ অভিযান। সোমবার উচ্ছেদের পর হকারদের একটি দল মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দিয়ে আসে। পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ না করা, হকারদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, হকারদের উপর দমন-পীড়ন বন্ধ এবং প্রকৃত হকারদের তালিকা করে পরিচয়পত্র দেওয়াসহ ১০ দফা দাবির কথা সেখানে তুলে ধরেন তারা।অন্যদিকে নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে মেয়র সোমবার বলেন, জনগণের চলাচল নির্বিঘœ করতে করপোরেশেন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।মঙ্গলবারের সমাবেশে মেয়রের ওই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে হকার সমন্বয় পরিষদের নেতা আবুল হোসেন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী হকারদের উচ্ছেদ করতে বলেননি। প্রধানমন্ত্রী একনেক বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার আলোকে ব্যবস্থা নিন।

মেয়র একা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী (বিদেশ থেকে) ফিরে আসুন, স্থানীয় সাংসদও বিদেশে আছেন। তারা আইন প্রণেতা।…আপনার হকার উচ্ছেদের এ সিদ্ধান্ত অমানবিক।সুইজারল্যান্ড সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তার সঙ্গে দেখা করে হকার উচ্ছেদের প্রতিবাদে স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয় সমাবেশে।কর্মসূচির এক পর্যায়ে হকার সমিতির নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, গুলিস্তান এলাকায় তালিকাভুক্ত হকারের সংখ্যা ১৬ শ’। বাকিরা হকার নয়।হকারদের একাধিক সংগঠন থাকাও তাদের দুর্দশার একটি কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তার এ বক্তব্যের পর হকারদের একটি অংশ তাকে মারতে উদ্যত হলে অন্য নেতারা নুরুল ইসলামকে সমাবেশস্থল থেকে সরিয়ে দেন।বাংলাদেশ জাতীয় হকার্স ইউনিয়নও মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে পল্টনের মুক্তিভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে।দৈনিক বাংলা, দিলকুশা, রাজউক এভিনিউ, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, জিরো পয়েন্ট হয়ে পল্টনে এসে শেষ হয় তাদের মিছিল। মিছিল শেষে সমাবেশে হকার্স ইউনিয়ন নেতা হযরত আলী অভিযোগ করেন, সোমবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বৈঠকে হকার উচ্ছেদ না করতে অনুরোধ জানানো হলেও মেয়র তা শোনেননি।উচ্ছেদের কারণে হকাররা কেউ ভালো নেই, আর হকাররা ভালো না থাকলে মেয়রও ‘ভালো থাকবেন না’ বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি।

মেয়র সাহেব, আপনি আমাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। আমাদেরকে না খাইয়ে রাখলে, আমাদের অনাহারে রাখলে আমরা কাউকে ভালো থাকতে দেব না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ফুটপাতে দোকান করতে না পারব ততক্ষণ আমরা ঘরে ফিরে যাব না।হকারদের পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন এ সমাবেশের বক্তারা।বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় পল্টনের মুক্তি ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে সমাবেশে বক্তারা জানান।

এদিকে, কর্মদিবসে রাজধানীর ফুটপাত ও রাস্তা হকারমুক্ত রাখার সিদ্ধান্তে সাধারণ পথচারীদের মধ্যে স্বস্তি বিরাজ করছে। প্রতিবন্ধকতামুক্ত ফুটপাতে নির্বিগ্নে পথ চলতে পেরে তারা আনন্দিত।ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) এই প্রশংসনীয় উদ্যোগকে তারা স্বাগত জানিয়ে বলেন, কোন রাজনৈতিক বা অন্য কোন কারণে যাতে কয়েকদিন পর আবার সিটি কর্পোরেশন তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসে, যে কোনমূল্যে এই অবস্থা ধরে রাখতে হবে।ফুটপাত হকারমুক্ত করার পাশাপাশি তাদের পূনর্বাসনের উপর গুরুত্বারোপ করে তারা বলেন, প্রকৃত হকারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারন করতে হবে এবং যাতে সরকারের পুনর্বাসনের সুবিধা ভূক্তভোগীরাই পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুবিধাভোগীরা যাতে সরকারের উদ্দেশ্য বানচাল করতে না পারে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

সিটি কর্পোরেশনের হকারমুক্ত ফুটপাতের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর বিভাগের হিসাব শাখার কর্মকর্তা আবু তাহের বাসসকে বলেন, মুগদা থেকে নিয়মিত আমি ফুটপাত ধরে পায়ে হেঁটে সচিবালয়ে অফিস করি। হকারদের দখলে থাকার কারণে ফুটপাতে হাঁটতে অনেক সমস্যা হতো। অনেক সময় পথ চলতে হোঁচট খেতে হতো। কিন্তু এখন অনেক স্বাচ্ছন্দে পথ চলতে পারছি।বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং সার্ভিসেস লিমিটেডের মানবসম্পদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস এম আমিনুল মমিন বলেন, সিটি কর্পোরেশনের এটি একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। ফুটপাতের দোকানপাটের কারণে সারা ঢাকা শহরকেই মনে হতো একটা বাজার। যে যেখানে পারবে দোকান বসিয়ে দেবে, এটা হতে পারে না। কোন সভ্য সমাজে এমন বিশৃংখল অব¯’া বেশিদিন চলতে দেয়া যায় না। মেয়র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের উচিত মেয়রকে সহযোগিতা করা।উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অভিভাবক শাহনাজ বেগম নদী বলেন, ফুটপাতে দিনের বেলা হকার বসতে না দেয়ার ব্যাপারে মেয়রের সিদ্ধান্তে আমরা অনেক খুশি। ফুটপাতে দোকানপাট না থাকায় এখন ভালভাবে হাঁটাচলা করা যায়। রাস্তায়ও যানজট অনেকটা কমে গেছে। রাস্তায় এখন ভালভাবে চলা যায়, যেখানে আগে হাঁটতে গেলে মানুষের গায়ের সাথে প্রায়শই ধাক্কা খেতে হতো। এখন আর তা হয় না।একটি প্রাইভেট কলেজের প্রভাষক মিজানুর রহমান সিটি কর্পোরেশনের হকারবিহীন ফুটপাতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটা খুবই ভাল একটি কাজ হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে মেয়রকে অনড় থাকতে হবে। কোন রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী মহলের চাপে মেয়র যাতে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসেন।তিনি বলেন, সবকিছুকে একটা শৃংখলার মধ্যে আনা মেয়রের দায়িত্ব। ফুটপাত ও রাজপথ হকারমুক্ত করে মেয়র তার সঠিক দায়িত্বই পালন করছেন। তবে যানজট ও জঞ্জালমুক্ত শহর গড়তে মেয়রকে যত্রতত্র গাড়ী পার্কিং, লেগুনা, বাস ও রিক্সাসহ গণপরিবহনকে একটা শৃংখলার মধ্যে আনতে হবে।গত রোববার থেকে সাপ্তাহিক কর্মদিবসে দিনের বেলায় ফুটপাত ও রাস্তা হকারমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসসিসি।