রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা এগিয়ে নিতে ২৩ অক্টোবর মিয়ানমারে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তবে তিনি রাখাইনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমাদের মূল এজেন্ডা হবে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে- সে বিষয়ে আলোচনা করা। রোহিঙ্গা সঙ্কট ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় চারটি পূর্বনির্ধারিত বিষয়ে মিয়ানামার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হবে বলে জানান কামাল। তিনি বলেন, ২৩ তারিখ তার যাত্রার সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয়েছে; সফর শেষে ২৫ অক্টোবর তিনি ফিরবেন।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব, পুলিশ প্রধান, বিজিবি প্রধান, কোস্টগার্ড প্রধান, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) এই সফরে মন্ত্রীর সঙ্গে থাকছেন।মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর ২৫ অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত সোয়া পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা আসছে; এখনও রাখাইনে দমন-পীড়ন চলার খবর মিলছে তাদের কাছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে আপত্তি জানিয়ে আসা মিয়ানমার সরকারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি আন্তার্জাতিক চাপের মুখে গত ১৯ সেপ্টেম্বর দেশটির পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত আছে।

সে সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।এরপর সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে ঢাকায় এসে গত ২ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয় সেখানে।এ বিষয়ে আরও আলোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিগগিরই মিয়ানমার সফরে যাবেন বলে সেদিনই জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।মিয়ানমারের মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে ওই চুক্তির খসড়াও হস্তান্তর করা হয়।

তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ওই খসড়ার বিষয়ে এখনও কোনো জবাব মেলেনি বলে গত ৯ অক্টোবর বিভিন্ন দেশের দূতদের সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত মঙ্গলবার ঢাকায় এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার পেছনে ‘আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করার কৌশল’ থাকতে পারে বলে বাংলাদেশ মনে করছে।রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা চার লাখের মত রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে।

বেশ কিছুদিন কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে চিহ্নিত করা হলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি।

বাংলাদেশ সরকার বলছে, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় আলাদা হওয়ায় ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশ মানবিক কারণ সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও সহায়তা দিলেও তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতেই হবে। যেসব এলাকায় রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, মিয়ানমার সফরে সেসব এলাকায় যাবেন কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বলেন, যদি তারা আমাদের অনুমতি দেয়, তাহলে আমরা সেখানে যাব। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন করলে মন্ত্রী বলেন, উখিয়া টেকনাফ এলাকায় এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা স্থানীয় বাসিন্দাদের চারগুণ। যদি তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনা দীর্ঘ হয়, তাহলে ভাসানচরে তাদের নেওয়ার কথা ভাবা হবে।এখন যারা আসছে তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথাবার্তা আমরা বলছি। কিন্তু এর আগে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে তো কোনো আলোচনাই হচ্ছে না।