উত্তরা লের চলনবিলে এখন মাছ ছাড়াও ধান, শরিষা, রসুনের পাশাপাশি মধু উৎপাদনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রতি বছর মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা বিলা ল। এ অ লের ফসলের মাঠে সরিষার হলুদ ফুলের সমারেহে মধু উৎপাদনে এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় গত বছর চলনবিল অ ল থেকে প্রায় দেড় হাজার টন মধু আহরণ হয়। এবার দেখা গেল তার উল্টো চিত্র। মৌসুমের শুরুতে ইউরোপিয়ান হাইব্রীড এপিস মেলিফেরা মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা বিলা ল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসে আর কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে মৌ-বাক্্ের। কিন্তু হঠাৎ করেই আবহাওয়ার পরিবর্তন। শুরু হয় প্রবল শৈত্যপ্রবাহ,কনকনে শীত আর ঘন কুয়াশা। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন অ ল থেকে আসা চলনবিলের ৬ শতাধিক মৌচাষী হতাশ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড শীতে মৌমাছি মৌবাক্স থেকে বের হচ্ছে না। বের হলেও তারা আর বাক্সে ফিরছে না। ঠান্ডায় অসংখ্য মৌমাছি মারা যাচ্ছে। হতাশ হয়ে পড়েছেন মৌচাষীরা। মৌমাছির মৃত্যু আর লোকসান তাদেরকে হতাশ করে তুলেছে।

চলতি মওসুমে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চলনবিল থেকে এক হাজার ৫’শ থেকে এক হাজার ৬’শ টন মধু আহরণের সম্ভাবনা ছিলো বলে জানালেন উত্তরা ল মৌচাষী সমিতির সভাপতি মোঃ জাহাঙ্গীর আলম। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনি¤œ ১৫০ টাকা হিসেবে ২২ থেকে ২৫ কোটি টাকা। প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অ লের প্রায় ৬ শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌচাষিরা সরষে ক্ষেতের আলে ৪৫ থেকে ৫৫ হাজার মৌবাক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরষে ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন। কিন্তু এবারের শীত আর শৈত্য প্রবাহ মৌচাষীদের সর্বনাশ করেছে। সব মিলিয়ে ৫শ’ মে.টন মধু সংগ্রহ করাই দুরুহ। তার উপর মারা যাচ্ছে মৌমাছি। তিনি জানালেন,শৈত্যপ্রবাহের কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখনও যদি সপ্তাহ খানেক রোদ থাকে আর শীত কমে যায়,তাহলে কিছুটা লোকসান পোষাবে। ইতোমধ্যেই শতাধিক খামারী চলনবিল ছেড়ে বগুড়া অ লে চলে গেছেন।

উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমিতির সভাপতি পাবনার চাটমোহরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম আরো জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দ্বিগুণ মৌবাক্্র নিয়ে হাজির হয়েছিলো মৌচাষিরা। চলনবিল শুধু মাছের বিলই নয়; এখন মধু উৎপাদনের বিল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। মধু উৎপাদনে চলনবিল এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন তাই নয়। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরষের ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরষের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।

এ অ লে উৎপাদিত ভেজালমুক্ত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য ভারতের ডাবর কোম্পানী, প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ ব্যান্ড প্রসাধনী কোম্পানীর এজেন্টরা চলনবিলের মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করে। সুন্দরবনের মধুচাষিরা চলনবিলে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে মধু সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়ে,চলে পুরো জানুয়ারি মাস। এবার মৌচাষীদের আশা ধুলিস্যাৎ করেছে প্রতিকূল আবহাওয়া। চলনবিল এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা আলম শিকদার বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি মধু আহরণ করছেন। কিন্তু এবারে মাত্র কয়েক দিনের শীত ও শৈত্যপ্রবাহ তাদের সর্বনাশ করেছে। তিনি মনে করেন গত বারের চেয়ে অনেক কম মধু সংগ্রহ হবে। গত বছর দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার এক টনের বেশি মধু সংগ্রহ করা যাবে না।

বিসিক থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে অনেকেই মধু সংগ্রহ করছেন। তারা বলেন,একটি রানী মৌমাছির সাথে প্রায় ৩০০ শ্রমিক মৌমাছি নিয়ে একটি কাঠের ফ্রেমের মৌ-বাক্স করা হয়। কিন্তু বাক্সের অধিকাংশ মৌমাছি মারা গেছে। ফলে এবার মধু সংগ্রহে বিপর্যয় ঘটেছে।

এস এম মাসুদ রানা/ চাটমোহর, (পাবনা)