মোজাম্মেল হক চৌধুরী 

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২১ জানুয়ারি: বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছেন, এদেশের যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচির সহিংস থাবায় আক্রানত্ম হচ্ছে রাজপথ, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে যানবাহন, নির্মমভাবে নিহত হচ্ছে নিরীহ যাত্রী সাধারণ৷ ভষ্মীভূত হচ্ছে শত শত কোটি টাকার সম্পদ গণপরিবহন, পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে অংঙ্গার হচ্ছে যাত্রী,চালক, পরিবহন শ্রমিক৷ তথাকথিত প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়ে ভাংচুর করা হচ্ছে হাজার হাজার গাড়ি৷ ফলে গণপরিবহন সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে৷ আবার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে গণপরিবহন সংকটের কারণে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে যাত্রী সাধারণের৷

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি “গণপরিবহনে রাজনৈতিক সহিংসতা নিরসন কর্মসূচির” আওতায় দেশের দশটি জাতীয় ও পাঁচটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রতিবেদন মনিটরিং করে গণপরিবহনে রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ক এক প্রতিবেদন-২০১৫ বুধবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রকাশকালে সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী অভিযোগ করে উপরোক্ত বক্তব্য রাখেন৷

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০১৩ সালের জানুয়ারী থেকে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কালে ২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারী পর্যনত্ম রাজনৈতিক সহিংসতার পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে ২২২জন যাত্রী ও ৭৩জন চালক ও পরিবহন শ্রমিক নির্মম ভাবে নিহত হয়েছে৷ এসময় ২৬,৩৭৪টি যানবাহন ভাংচুর ১,১৬২টি যানবাহনে আংশিক অগি্নসংযোগ ও ৭৮১টি যানবাহন সম্পুর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে দুস্কৃতিকারীরা৷ এছাড়া ফিসপেস্নট খুলে ও রেললাইন উপড়ে ২১দফা রেলে নাশকতা চালানো হয় এবং ৩ দফা নৌ-পথে নাশকতার প্রচেষ্টা চালায় দুষকৃতিকারীরা৷ এ সকল নাশকতায় আহত হয়ে ৩,৭৩,৪২৫ জন যাত্রী, সারাদেশের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে চিকিত্‍সা নিয়েছে৷ এসব ঘটনায় প্রায় ১৩,২২৩ জন যাত্রী পঙ্গুত্ববরণ করেছে৷ ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের সকল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ভয়ংকর চিত্রে বিবেকবান মানুষ ভারাক্রানত্ম না হয়ে পারে না৷ এসব সহিংসতায় ৰতিগ্রস্থ পরিবহন শ্রমিকদের সংশিস্নষ্ট শ্রমিক সংগঠনের পৰথেকে চিকিত্‍সা সহায়তা ও আংশিক ৰতিপূরণ দেওয়া হলেও সাধারণ যাত্রীরা সরকার বা কোন সংস্থা থেকে কোন প্রকার চিকিত্‍সা/আর্থিক সহায়তা পায়নি৷

২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারী থেকে ২০ জানুয়ারী পর্যনত্ম তথাকথিত হরতাল অবরোধের রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৮ যাত্রী ১১ পরিবহন চালক ও শ্রমিকের মৃতু্য হয়৷ একই সময় সারা দেশে ৫৭২টি যানবাহনে আংশিক অগি্নসংযোগ ৬৫টি যানবাহন সম্পুর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে দূষ্কৃতিকারীরা৷ এছাড়াও ভাংচুর করা হয়েছে ৩,২৩১টি যানবাহন৷ এছাড়াও সরকারী পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির ৫০টি বাসে অগি্ন সংযোগ ও ৩১৭টি বাস ভাংচুর করা হয়েছে৷ এসময় ৪ দফা রেলে নাশকতা চালানো হয়৷ এসকল ঘটনায় আহত হয়ে ৫৫,২১৭ জন যাত্রী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্‍সা নিয়েছে৷ গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপুর্তিতে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পাল্টাপাল্টি কর্মসুচির কারণে আবারো সহিংসতা শুরম্ন হয়৷ ওইদিন রাতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধ কর্মসুচি ঘোষনা করলে সরকার সমর্থিত পরিবহন মালিকরা অবরোধ উপেৰা করে রাসত্মায় গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয়৷ কিন্তু নাশকতার ভয়ে পরিবহন চালকরা রাস্তায় নামতে সাহস পাচ্ছেন না৷ তারপরও পেটের দায়ে রাস্তায় গাড়ি নামাতে বাধ্য হচ্ছেন চালক ও পরিবহন শ্রমিকেরা৷ জীবন জীবিকার তাগিদে ঘরথেকে বের হয়ে যাত্রী, চালক, পরিবহন শ্রমিককে নির্মম ভাবে জীবন দিতে হচ্ছে৷

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়কে বিজিবি ও পুলিশ পাহারায় যাত্রী ও পন্যবাহী বাস/ট্রাক চলাচলের চেষ্টা চলছে৷ তবে তা খুবই সীমিত৷ কোটি টাকা দামের অভিজাত বাসগুলো রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না সহিংসতার কারণে৷ রাজনৈতিক প্রতিপৰকে ঘাঁয়েলের অস্ত্র হিসেবে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে গণপরিবহন ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে৷ জনগণের ব্যবহারের রাস্তা রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এটা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি বলে আমরা মনে করি৷ তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক কর্মসুচি ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দল কৌশল হিসেবে পরিবহন খাতকে ব্যবহার করছে৷ সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরম্ন হয়ে প্রায় তিন দশক ধরে এই গণপরিবহন ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রবনতা প্রকট হয়ে উঠেছে৷ বাসত্মবতার আলোকে প্রতিয়মান হয় চারদলীয় জোট সরকার আওয়ামীলীগের বড় ধরনের কর্মসুচি ঠেকাতে পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিত৷ সবসময় সরকার সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সরকার বিরোধীদের কর্মসূচি ঠেকাতে গণপরিবহনকে ব্যবহার করে আসছে৷ এৰেত্রে তারা যাত্রী ও শ্রমিকদের জীবন ও স্বার্থের কথা ভাবছেন না৷ একটা স্বাধীন ও সভ্য দেশে জন্য এটা খুবই দুঃখজনক৷ সারা দেশের সড়ক পরিবহনে যে ক্ষতি হচ্ছে তার পরিমাণ প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৬০ কোটি টাকা৷ রাজধানীর সঙ্গে দেশের সকল জেলায় সড়ক যোগাযোগ এখনো সচল নয়৷ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ যেন ডেডলক হয়ে গেছে৷ পরিসংখ্যানে জানা যায় শুধু ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধে সড়ক পরিবহনে ২৮-৩১ হাজার কোটি টাকার ৰয় ক্ষতি হয়েছিল৷ রাজধানীতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, দেশ সচল আছে৷ আজ সারাদেশে প্রতিটি নাগরিকের জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে৷ পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীরা প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি জানতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন৷ প্রতিদিন সহিংসতা নতুন নতুন রূপ নিচ্ছে৷ যে মানুষ মারা যাচ্ছে তারা সরকার বা বিরোধী পৰের নেতা-কর্মী নয়, নিহত হচ্ছে সাধারণ মানুষ যাদের অপর নাম যাত্রী৷ গণমানুষ বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে গণপরিবহন ব্যবস্থা৷ বিশ্বের সভ্য দেশগুলোয় গণমানুষের রাস্তা ও পরিবহন জিম্মি করে নাশকতা চালানোর কোন নজির নেই৷ রাজনৈতিক কর্মসূচী ও আন্দোলনের ধরণ পাল্টানোর আহ্বান জানাচ্ছি রাজনৈতিক দলগুলোকে৷ কারণ রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য৷ মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়৷ তাই অত্র সংগঠনের পৰথেকে রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত, নিহত, পঙ্গুত্ব বরণকারী সকল যাত্রীর চিকিত্‍সা ও পুনর্বাসনের দায়-দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রকে নেয়ার জোর দাবী জানাচ্ছি৷

সংগঠনের চেয়ারম্যান শরীফ রফিকউজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব মো: মোজাম্মেল হক চৌধুরী৷ এসময় অন্যান্যর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রাজীব মীর, অধ্যৰ কামাল আতাউর রহমান, তেজগাঁও কলেজের অধ্যাপক আশিক খান নতুন, ব্র্যাকের গবেষক প্রিচিলা রাজ, সমিতির সহসভাপতি ডা. এ.এম শামিমুজ্জামান, যুগ্ম মহাসচিব এম মনিরম্নল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রম্নমি, কেন্দ্রীয় সদস্য ইয়াসমিন আক্তার সীমা, মাহমুদ হোসেন, ইমাম হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন৷