12-12-15-PM_Padma Bridge Opening-2

দৈনিকবার্তা-শরীয়তপুর, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫: দেশের দক্ষিণ জনপদকে সড়কপথে সরাসরি রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করতে দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে পদ্মায় সেতু নির্মাণের যে স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল, এবার তাকে চূড়ান্ত আকৃতি দেওয়ার কাজ শুরু হল।শুরু হয়ে গেলো স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণযজ্ঞ। শনিবার পদ্মার জাজিরা পাড়ে নদীশাসন ও মাওয়া পাড়ে পাইলিং কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়।স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। প্রথমে তিনি বেলা সোয়া ১১টার কিছুক্ষণ পর মাওয়ায় নদীশাসন কাজের উদ্বোধন করেন, এরপর দুপুর একটার কিছুক্ষণ আগে সুইচ অন করে উদ্বোধন করেন পাইলিংয়ের। প্রধানমন্ত্রী সুইচ অন করার সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল ও ভারী হ্যামার দিয়ে শুরু হয় প্রমত্তা পদ্মার গভীরে পাইলিং কাজের।বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে বেলা ১১টা ১৬ মিনিটে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের নাওডোবায় পৌঁছান। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই ফলক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে পদ্মা নদীশাসনের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।এরপর মোনাজাতে পদ্মাসেতু প্রকল্পের সফলতা কামনা করেন তিনি। ফলক উন্মোচনের পর শুরু হয় পদ্মার নদীশাসনের কর্মযজ্ঞ।এরপর পাশে আয়োজিত সুধী সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।এতে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শরীয়তপুর-১ (জাজিরা) আসনের সংসদ সদস্য বিএম মোজাম্মেল হক প্রমুখও।মাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর এক কিলোমিটার ভেতরে শুরু হয় সাত নম্বর পিলারের মূল পাইলিংয়ের কাজ। এরকম মোট ৪২টি পিলারের ওপর ভর দিয়েই প্রমত্তা নদীর দুই তীরকে যুক্ত করবে পদ্মা সেতু।

প্রধানমন্ত্রী আশা করছেন, ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু আগামী তিন বছরের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে।সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেনও চলবে।জাজিরায় নদীশাসন কাজের উদ্বোধনের পর এক সুধী সমাবেশে নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব। আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।এই সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ‘মিথ্যা অভিযোগ’ এবং নানা বাধা বিপত্তির কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালি জাতি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না।আমরা সেই জাতি, যে জাতি সম্পর্কে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’, আজকেও সেটি প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।

প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই সেতু দিয়ে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলা।এ সেতু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হবে বলে আশা করছে সরকার।জাজিরার অনুষ্ঠান শেষে নদীপথে অন্য পাড়ের মাওয়ায় পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। পথে নদীর মধ্যে সাত নম্বর পিলারের পাইলিং কাজের জায়গাটিও দেখেন তিনি।মাওয়ায় সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের পাশে নিয়ে বোতাম চেপে পদ্মা মূল সেতু নির্মাণ কাজের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।এ সময় তিনি সবার কাছে দোয়া চান, যেন সময়মত নির্মাণ কাজ শেষ করা যায়।১৯৯৮ সালে আওয়ামী সরকার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ্ব ব্যাংক।কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে থাকে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক- যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন করে পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্ব ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে।এরপর পদ্মা সেতুতে সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ আনে বিশ্ব ব্যাংক। দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংককে না বলে দেয়। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন জানায়, দুর্নীতির কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। শেষ পর্যন্ত নকশা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের জুনে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানিকে মূল সেতু নির্মাণের কাজ এবং সিনো হাইড্রো করপোরেশনকে নদী শাসনের কাজ দেওয়া হয়।সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, প্রকল্পের প্রায় ২৭ শতাংশ কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। এই সেতু নির্মাণের পাশাপাশি মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত চার লেইনের সড়ক হবে। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে হবে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার।এছাড়া জাজিরা পয়েন্ট থেকে খুলনা, বেনাপোল, কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেইনের সড়ক নির্মণের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তিনি।বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন, নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান ও ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জাজিরা ও মাওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

আরও ছিলেন সেনা প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, পুলিশের আইজি শহীদুল হক, চিফ হুইপ আসম ফিরোজ, স্থানীয় সাংসদ সুকুমার রঞ্জন ঘোষ ও সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, দীপু মনি, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, পদ্মাসেতু নির্মাণ আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেকে এগিয়ে এসেও হঠাৎ পিছিয়ে গেছে।তিনি বলেন, আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজের প্রকল্প হাতে নিলে বিশ্ব ব্যাংক এগিয়ে আসে। কিন্তু হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া তারা দুর্নীতির অভিযোগ আনে। যদিও আমরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বিএনপি সরকারের সময়ের দু’টি দুর্নীতির কাগজ দেখায়।বাংলাদেশ একদিন পুরোপুরি স্বাবলম্বী হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারও কাছে হাত পেতে নয়। আমরা স্বাবলম্বী হয়ে চলবো। বাঙালি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না। বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আজও তা-ই প্রমাণিত হয়েছে। পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছি আমরা।

এরপর প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতুর পাইলিং কাজের উদ্বোধন করতে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পাড়ে চলে আসেন। এখানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দুপুর ১২টা ৫৭ সুইচ পাইলিংয়ের অন করার মাধ্যমে মূল সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন তিনি। এরপর এখানেও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, শত বাধার মুখেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, তারা পারে। অনেক ঝড়-ঝাপ্টা-চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, ভিক্ষা চেয়ে নয়, হাত পেতে নয়, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করছে। বাংলাদেশ পারবে। আমি বিশ্বাস করি। লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। এখন এ স্বাধীন দেশের মানুষই পদ্মাসেতু নির্মাণ করবে। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে বলেন, ‘হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই’ বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনে। আমি বলি, দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। কারণ তখনও টাকা ছাড় হয়নি।আজ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করতে পারে নাই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির এই অভিযোগ নিয়ে কানাডায় মামলার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই মামলায় সে দেশের আদালতও বিশ্ব ব্যাংককে দুর্নীতির প্রমাণ দিতে বলেছে।ঘটনা ছিল অন্য। কোনো এক স্বনামধন্য ব্যক্তি, যিনি আইন ভঙ্গ করে ১১ বছর ধরে একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিল- ছেড়ে দিতে, তখন তিনি মামলা করলেন। মামলায় হেরে তাকে এমডি পদ ছেড়ে দিতে হয়।আমেরিকায় ই- মেইল গেছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি সহযোগিতা চেয়েছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান তার শেষ কর্মদিবসে ওই অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। শেখ হাসিনা বলেন, আমি জাতির পিতার সন্তান। সব হারিয়ে আমি জনগণের কাজ করছি। আমি দুর্নীতি করি নাই। আমার পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতি করে না।বক্তব্যের শুরুতেই সমবেত স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এখানে বক্তব্য দিতে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি। যারা দূরে আছেন, তারাও দূরে নাই, আপনারা আমার আত্মার পরম আত্মীয়। যারা এই সেতু নির্মাণের জন্য জমি দিয়েছেন, ভিটা মাটি দিয়েছেন তাদের জন্য আমার কৃতজ্ঞতা। বিগত সরকারগুলোর সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত যখনই ক্ষমতায় আসে এই সেতু নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেয়। শুধু বন্ধই করে নাই, এই সেতু নিয়ে যায় পাটুরিয়া পয়েন্টে।তিনি বলেন, সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অকার্যকর করে দেওয়ার যে এক ষড়যন্ত্রৃআমরা সব দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম।প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জানান, তিনি সুইচ অন করতেই সেতুর পাইলিং শুরু হয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মার গভীরে। পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী মাওয়ায় তার জন্য নির্ধারিত ঘর ‘পদ্মা-১০’ এ বিশ্রাম নিচ্ছেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রী মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের উত্তর মেদেনীমণ্ডলে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। তার আগমন উপলক্ষে ইতোমধ্যেই জনসভাস্থলে সমবেত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।