মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে সরকার এবং কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির মধ্যে চলমান সংঘাত নিয়ে গত ১৭ মে নিবন্ধ প্রকাশ করে ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও গেরিলা গোষ্ঠী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) মধ্যে চলমান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে হাজারো সাধারণ মানুষকে জঙ্গলে পালিয়ে যেতে হচ্ছে।গত এপ্রিলে শুরু হয়ে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ কাচিন রাজ্যের রাজধানী মিতচিনার স্থানীয় একটি গির্জায় আশ্রয় নিয়েছে।তবে সেখানে পৌঁছানোর আগে কয়েক সপ্তাহ তাদের বনের নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হয়।এখনো অনেক মানুষ পাহাড়ি অঞ্চলে আটকা পড়ে আছে।কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহী বাহিনী কেআইএ মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। মিয়ানমারের এদিকটাতে সংঘাত সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সংঘাতের লক্ষ্য বোঝাটা কঠিন। যদিও স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বিদ্রোহী গোষ্ঠীকেই দোষারোপ করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ঘাঁটিগুলোতে নিয়মিত আক্রমণ চালাচ্ছে।
প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এ হামলার একটি কারণ হতে পারে। তানা এলাকাটি সোনাসহ খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। এটি কেআইএর উপার্জনের বড় উৎস। তাই এখানে খুব ঘনঘন হামলা করে মিয়ানমার সেনারা। গত বছরের জুনে এই সেনাবাহিনী একটি আক্রমণ চালায়, যেটিকে তারা নিজেরাই বেআইনি হামলা বলে জানিয়েছিল।তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই উপর্যুপরি হামলার পরও নির্বিকার রয়েছে দেশটির সরকার।আর এত কিছু সত্ত্বেও শান্তিই তার মূল লক্ষ্য বলে জানান মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। তিনি সভা-সমাবেশ করছেন, আর ঐক্যের বিষয়ে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই যুদ্ধের বেলায় তাঁর ভাষণের কোনো প্রভাব পড়েনি। এটি মূলত সেনাবাহিনীর কাজ। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, দেশের বেসামরিক কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী অথবা পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। কিন্তু সরকারকে এ বিষয়ে একেবারে অসহায় দেখায়।সংবাদমাধ্যম দি ইকোনমিস্টের ভাষ্যমতে, প্রকৃতপক্ষে, বেসামরিক সরকার যতটা বলে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে। রাজনীতিকরা দেশের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হয়ে আদালতে মধ্যস্থতা করতে পারেন। দেশের এমপিরা পারেন সেনাবাহিনীর বাজেট পুনর্বিন্যাস করতে। পরিশেষে নির্বিকার না থেকে অং সাং সু চি সেনাবাহিনীর সমালোচনা করতে পারেন। এই হামলার একটা অবসান ঘোষণা করতে পারেন। রেড ক্রসের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত এপ্রিল থেকে এই পর্যন্ত সাত হাজার সাধারণ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে। এর আগেও নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল আরো এক লাখ সাধারণ মানুষ।
এ ছাড়া বেশ কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক লঘু সম্প্রদায় থেকে কয়েকটি গেরিলা বাহিনী তৈরি হয়েছে, যারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে কয়েক দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে।২০১৫ সালে এই বাহিনীগুলোর অনেকেই যুদ্ধবিরতির সঙ্গে সহমত হয়েছিল। কিন্তু কেআইএ এই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়নি। এই বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা এখন প্রায় ১০ হাজার।কাচিনের নারীদের একটি সংগঠন জানায়, দেশটির যোদ্ধারা সাধারণ মানুষকে তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। শরণার্থীদের সহায়তায় নতুন কোনো ক্যাম্প তৈরি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে মিয়ানমার সেনারা। যদিও এতে খুব সহজেই এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকে সাহায্য করা যায়।যুদ্ধাবস্থায় অপমানিত-অবদমিত হয়ে কাচিনের তরুণরা তাদের রাজধানীতে একটি আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের আয়োজকদের বিরুদ্ধেও মানহানি আইন করা হয়, যার শাস্তি দুই বছরের কারাভোগ।এদিকে, যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভও দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনসহ, গ্রামাঞ্চল ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এক তরুণ বলেন, ‘গৃহযুদ্ধের ফলে আমরা বহুদিন ধরে ভুগছি।কাচিনের এক বিদ্রোহী কর্মী খোন জা বলেছিলেন, মিয়ানমারের শান্তি রক্ষায় পরামর্শদাতা হলেন অং সান সু চির সাবেক ব্যক্তিগত চিকিৎসক। কাচিনের দায়িত্বে তিনি যে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন তিনিও একজন দন্ত চিকিৎসক। এই প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে স্থানীয় এক নেতা বলেছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হতে ভয় পান।এদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে সরকার ও সেনাবাহিনী। সেনাদের অভিযানের পর থেকে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধন করছে সেনারা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এর আগে বেশির ভাগ সময় নিশ্চুপ থেকেছে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকার।