লেবাননের রাজধানী বৈরুত সমুদ্রবন্দর ঘিরে উৎসবের আমেজ। গত ৯ বছর ধরে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সর্বশেষ যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়ের ১১০ জন শান্তিরক্ষীকে দেওয়া হলো ‘জাতিসংঘ শান্তিপদক’। এই অনুষ্ঠান ঘিরে বুধবার (১২ জুন) বৈরুত বন্দরে বাংলার লাল সবুজের এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া দেশি-বিদেশি অতিথিরা জানান, এমন বর্ণিল সম্মিলন কখনও দেখেনি বৈরুত বন্দর। সেখানে মনোমুগ্ধকর প্যারেডেরও আয়োজন করা হয়। বিএনএস বিজয়ের সাজসজ্জা, নাবিকদের উদ্দীপনা দেখে মনে হয়, এ বন্দর যেন একখণ্ড বাংলাদেশ।

বৈরুত বন্দরে বিএনএস বিজয়ের আঙিনায় ঢুকতেই চোখে পড়ল সুসজ্জিত একটি অস্থায়ী ফটক। সমুদ্র আর যুদ্ধজাহাজ দেখতে আসা পর্যটকদের যেন স্বাগত জানায় এটি। ফটকের একপাশে জাতিসংঘের পতাকা ও আরেক পাশে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পতাকা অঙ্কিত। নিচে সুসজ্জিত লালগালিচা। ফটক পার হবার পরই দেখা গেল বৈরুত বন্দরে নোঙর করা বাংলাদেশের যুদ্ধজাহাজ বানৌজা বিজয়কে। পুরো জাহাজে লেবাননে অংশ নেয়া ৪৩টি দেশের পতাকা পৎ পৎ করে উড়ছে। লেবাননে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অসামান্য অবদানের জন্য বিএনএস বিজয়ের ১১০ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে ‘জাতিসংঘ শান্তিপদক’ প্রদান অনুষ্ঠান ঘিরে বুধবার বৈরুত বন্দরে এমন বর্ণিল সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে লেবাননে নিয়োজিত জাতিসংঘের মেরিটাইম টাস্কফোর্স (এমটিএফ) কমান্ডার ব্রাজিল নেভির রিয়ার এডমিরাল এডওয়ার্ড অগস্টো উইল্যান্ড প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে শান্তি পদক পরিয়ে দেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার, লেবাননের নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল হোসনি দাহের, মেডেল প্যারেড উপলক্ষে সফররত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমডোর মোজাম্মেল হক, ব্যানকন-৯ এর কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ও বিএনএস বিজয় এর কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন এম নজরুল ইসলাম।

এছাড়াও লেবাননে নিযুক্ত ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস ইন্টিরিম ফোর্স ইন লেবানন’-এর (ইউনিফিল) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, লেবাননে বসবাসকারী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও অন্যান্য কমিউনিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে ভূমধ্যসাগরে লেবাননের জলসীমানায় বাংলাদেশি যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয় ‘বাংলাদেশি কন্টিনজেন্ট ব্যানকন-৯’-এর তত্ত্বাবধানে কাজ করছে। লেবানন মিশনে দায়িত্বরত নৌবাহিনীর ১১০ শান্তিরক্ষী তাদের দায়িত্ব পালন শেষে আগামী মাসে দেশে ফিরে যাবেন। তার আগেই তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন সমসংখ্যক নৌ সেনার একটি দল।

প্রধান অতিথি জাতিসংঘের মেরিটাইম টাস্কফোর্স (এমটিএফ) কমান্ডার ব্রাজিল নেভির রিয়ার এডমিরাল এডওয়ার্ড অগস্টো উইল্যান্ড তার বক্তব্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশ নেভি এখানে চমৎকার কাজ করছে। আমরা তাদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে লেবাননে বাংলাদেশ নৌবহিনীর সদস্যরা মেরিটাইম টাস্কফোর্সের আওতায় কাজ করছেন। এটা অত্যন্ত গৌরবের। এ সময় তারা দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করেছে। লেবাননের শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক অবদান রয়েছে।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমডোর মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশ নেভাল কন্টিনজেন্ট সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব নিয়ে এখানে কাজ করছে। তিনি বলেন, লেবাননের প্রয়োজনে যে কোনো সময় আরও নৌ সদস্য এবং যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত। বিশ্ব শান্তিরক্ষার অংশ হিসেবে ভূমধ্যসাগরে লেবাননের জলসীমায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সম্মানের। বাংলাদেশের নৌ-সদস্যরা এখানে তাদের ইতিবাচক ভূমিকার স্বাক্ষর রাখছেন।

জানা গেছে, জাতিসংঘের কোনো ইউনিটের অধীনে অন্তত ছয় মাস শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কেউ নিয়োজিত থাকলে তাকে শান্তিপদক দেওয়া হয়। জাতিসংঘ, লেবানন ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শান্তিপদক প্রদান অনুষ্ঠান শুরু হয়।

উল্লেখ্য, প্রথম ২০১০ সালে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ ওসমান ও মধুমতি লেবাননের শান্তিরক্ষা মিশনে (ইউনিফিল) অংশ নেয়। জাতিসংঘের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা নিয়ে ভূমধ্যসাগরে টহল দিত বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বর্তমানে লেবাননে দায়িত্ব পালন করছে বিএনএস বিজয়। লেবাননে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, জার্মানী, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া তুরস্ক-এই ৬টি দেশ জাতিসংঘ মেরিটাইম টাস্কফোর্সের হয়ে কাজ করছে। তারমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী এগিয়ে রয়েছে সবার চেয়ে বেশি।