KHALADA-1418813988

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৭ ডিসেম্বর: জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ২৪ ডিসেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন আদালত৷ ওই দিন খালেদা জিয়াকে অবশ্যই আদালতে হাজির থাকতে বলা হয়েছে৷

বুধবার বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ বাসুদেব রায় এ আদেশ দেন৷এদিন নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়ার করা অনুপস্থিতির আবেদনটি আদালত মঞ্জুর করলেও সময় চেয়ে করা আবেদনটি শুনানি শেষে খারিজ করে দেন৷আদালতে বেগম খালেদার পক্ষে শুনানি করেন- ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া৷ অপরদিকে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল৷

চলতি মাসের ৮ তারিখে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহন শুরু হয়৷ মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশীদ ওইদিন আদালতে সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন৷ বুধবার দুপুরের পর হারুন-অর-রশিদ তার অবশিষ্ট সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন৷ এ সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা ব্যাপক হট্টগোল করেন৷বুধবারবিকেলে রাজধানীর বকশীবাজারে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ বাসুদেব রায়ের অস্থায়ী আদালতে এ সাক্ষ্য দেন হারুন-অর-রশিদ৷ তিনি সাক্ষ্যগ্রহণের চতুর্থ কার্যদিবসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ আসামির বিরুদ্ধে ৫ মিনিট সাক্ষ্য দিয়েছেন৷

এর আগে দুপুর পৌনে দুইটায় শুনানি শেষে সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি চেয়ে দুই দফায় খালেদা জিয়ার করা সময়ের আবেদন খারিজ করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর আদেশ দেন আদালত৷ এ সময় নামাজ ও মধ্যাহ্ন বিরতি দেন আদালত৷ তবে নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে খালেদার অনুপস্থিতির আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ধার্য দিনে তাকে অবশ্য অবশ্যই হাজির করাতে আইনজীবীদের আদেশ দেওয়া হয়েছে৷

বিরতি শেষে বিকেল সোয়া চারটায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলে এজলাসক্ষে তুমুল হট্টগোল করেন খালেদার আইনজীবীরা৷ সাক্ষ্যগ্রহণকে বাধাগ্রস্থ করতে তারা এজলাসে বসা বিচারক ও কাঠগড়ায় থাকা সাক্ষীকে গালাগাল করছিলেন৷

সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে এজলাসে বসা বিচারককে গালাগাল করেন৷ এ সময় কাঠগড়ায় অসমাপ্ত সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন হারুন-অর-রশিদ৷ সাক্ষ্যগ্রহণকে বাধাগ্রস্থ করতে সাক্ষীকেও নানা ধরনের কটূক্তি ও হুমকি দিতে থাকেন খালেদার আইনজীবীরা৷খালেদার সিনিয়র আইনজীবীরা বসে থাকলেও বিএনপি-জামায়াতপন্থি জুনিয়র আইনজীবীরা এ হট্টগোল করেন৷ এ অবস্থায়ই আদালতের নির্দেশে ৫ মিনিট সাক্ষ্য দিতে পেরেছেন বলে পরে সাংবাদিকদের জানান বাদী হারুন-অর-রশিদ৷

এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর, ১ ডিসেম্বর ও ৮ ডিসেম্বর আরও তিন কার্যদিবসে সাক্ষ্য দেন একই সাক্ষী৷ ২৪ ডিসেম্বর পরবর্তী ধার্য দিনেও তার সাক্ষ্যগ্রহণের কথা রয়েছে৷গত ১ ও ৮ ডিসেম্বরও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে দফায় দফায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পেছানোর আবেদন জানিয়েছিলেন খালেদার আইনজীবীরা৷ ওই দু’দিনও শুনানি শেষে আদালত এসব আবেদন নামঞ্জুর করলে তুমুল হট্টগোল করেছিলেন তারা৷ এতে রাষ্ট্র ও দুদকের আইনজীবীদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে৷

বুধবারও আদালতে হাজির হননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া৷ সকালে তার পক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি চেয়ে চারটি সময়ের আবেদন জানান তার আইনজীবীরা৷ এর মধ্যে এ আদালতের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আদালত পরিবর্তনের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন শুনানির জন্য অপেক্ষমান থাকার কথা বলে দুই মামলায় দু’টি আবেদন করা হয়৷ শুনানি শেষে আদালত এ দুই আবেদন খারিজ করে বলেন, যেহেতু উচ্চ আদালত মামলার বিচারিক কার্যক্রমে কোনো স্থগিতাদেশ দেননি, সেহেতু সাক্ষ্যগ্রহণ চলবে৷ এরপর আদেশ পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন জানান খালেদার আইনজীবীরা৷ সে দুই আবেদনও খারিজ করে আদালতের কার্যক্রম বিরতি দিয়ে বিচারক বলেন, বিরতির পরে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে৷

অন্য দুই আবেদন করা হয় নিরাপত্তাহীনতার কারণে খালেদার অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করে৷ এ দুই আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ধার্য দিনে খালেদাকে অবশ্য অবশ্যই হাজির করাতে তার আইনজীবীদের আদেশ দেন আদালত৷আবেদনে তার আইনজীবীরা দাবি করেন, এ আদালতের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আদালত পরিবর্তনের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে, যা শুনানির জন্য অপেক্ষমান৷ এছাড়া খালেদা জিয়া এ আদালতে হাজির হতে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় হাজির হননি৷ তাই উচ্চ আদালতে করা আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি রাখার আবেদন জানাচ্ছি৷

শুনানি শেষে এ আবেদন খারিজ করে দিলেও খালেদার আইনজীবীরা তা পুনর্বিবেচনার জন্য ফের আবেদন জানান৷ এটিও শুনানি শেষে খারিজ করে বিরতি দিয়ে বিরতির পরে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর আদেশ দেন আদালত৷হারুন-অর-রশিদ খালেদার বিরুদ্ধে দায়ের করা অপর মামলা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলারও বাদী ও প্রথম সাক্ষী৷ একই আদালতে বিচার চলছে এ মামলারও৷

এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার প্রথম সাক্ষী বাদী হারুন অর রশিদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর থেকে আবেদন জানিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ কয়েকবার পিছিয়ে নেন খালেদার আইনজীবীরা৷ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খালেদার তিনটি লিভ টু আপিল বিচারাধীন থাকা বা হরতালের কারণ দেখিয়ে এসব আবেদন করা হচ্ছিল৷ তবে খালেদার সব আপিল ও লিভ টু আপিল সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেছে৷

খালেদা ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অপর পাঁচ আসামি হচ্ছেন- বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান৷

তাদের মধ্যে কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল এবং শরফুদ্দিন আহমেদ জামিনে আছেন৷ তারা আদালতে হাজির আছেন৷মামলার অপর আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে আছেন৷ তার পক্ষে তার আইনজীবীরা আদালতে হাজিরা দেন৷অপর দুই আসামি ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক৷

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন৷ এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাত্‍ করার অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়৷

মামলাটি তদন্ত করে দুদকের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ মোট ছয়জনকে অভিযুক্ত করে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন৷অন্যদিকে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দায়ের করা হয়৷ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ খান৷

মামলাটির অভিযোগে বলা হয়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়৷ কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উত্‍স ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি৷জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে৷২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ খান৷

২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া হাইকোর্ট থেকে আট সপ্তাহের জামিন পান৷ পরের বছরের ১৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়া ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জামিননামা দাখিল করেন৷

এ মামলায় অভিযুক্ত অপর তিন আসামি হলেন- খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তত্‍কালীন একান্ত সচিব বর্তমানে বিআইডবি্লউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান৷জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান জামিনে আছেন৷ হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক৷

গত ১৯ মার্চ এ দুই দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ঢাকা তৃতীয় ও বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়৷ খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে চার্জ গঠন করা হয় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর আট আসামির বিরুদ্ধেও৷

তবে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বিচার শুরুর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ৪১ বার ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ১১ বার চার্জ শুনানির জন্য আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেন খালেদা জিয়া৷ আর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর আবেদন জানিয়ে চার দফায় পিছিয়ে নেন৷গত ৭ মে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাত্‍ সংক্রান্ত বিশেষ মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের টাকা আত্মসাত্‍ সংক্রান্ত বিশেষ মামলার বিচারিক কার্যক্রম ঢাকার মেট্রোপলিটন দায়রা জজ-আদালত ভবনের পরিবর্তে ঢাকা মহানগরের বকশীবাজার এলাকার সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে নির্মিত অস্থায়ী আদালতভবনে চালানোর আদেশ জারি করে৷ফৌজদারি কার্যবিধির ৯(২) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ওই দুই মামলা পরিচালনার জন্য ভবনটিকে (যা বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলার অস্থায়ী আদালত ছিল) অস্থায়ী আদালত হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷