পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুই জঙ্গি নুরুল ইসলাম মারজান ও সাদ্দাম হোসেনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাঁদের শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। জঙ্গি সাদ্দামের শরীর থেকে তিনটি গুলি বের করা হয়েছে।শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদের ভাষ্য, দুই জঙ্গির ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। তাঁদের ভিসেরা, রক্ত ও ইউরিন সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলোও পরীক্ষা করা হবে।দুই জঙ্গির লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রয়েছে।গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুই জঙ্গি নিহত হন।শনিবার সকাল ১১টা ২০মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরআগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই দুই জঙ্গির মরদেহের ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছিলো।

ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, ওই দুই জঙ্গির মাথাসহ শরীরের একাধিক স্থানে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিগুলো তাদের শরীরের একদিকে দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। জঙ্গি সাদ্দামে শরীর থেকে তিনটি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিহত জঙ্গিদের পরিবারের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তাই তাদের মরদেহ মর্গের রাখা হবে।নিহত দু’জনের ভিসেরা, ডিএনএ ও মাসল টিস্যু সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের শরীরে কোনো মাদকের অস্তিত্ব আছে কিনা সেজন্য রক্ত ও ইউরিন পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান সোহেল মাহমুদ।পুলিশ জানিয়েছে, মারজান গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় জঙ্গিদের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। আর সাদ্দাম রংপুরের জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিসহ উত্তরাঞ্চলে একাধিক জঙ্গি হামলা ও হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি পাঁচটি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি এবং আরও পাঁচটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলারও আসামি। সাদ্দামকে গত বছরের ১৪ এপ্রিল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশ পরিচয়ধারী লোকজন তুলে নিয়ে এসেছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর বাবা তাজুল ইসলাম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলার মাস খানেক পর মারজানকে আটক করা হয়। এরপর কয়েক দিন বাস্তবিক অর্থেই মুখ বন্ধ রাখেন মারজান। এ সময় তিনি কথাবার্তাও বলেননি, খাওয়াদাওয়াও বন্ধ রেখেছিলেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হন মারজানের স্ত্রী আরেফিন প্রিয়তি।এর আগে ১২ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশ ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপের মাধ্যমে মারজানের বিষয়ে তথ্য জানানোর জন্য আহ্বান জানায়। ওই দিন তাঁর ছবি প্রকাশ করা হয়।এর আগে বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে রাজধানীর রায়েরবাজার বেড়িবাঁধের কাছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ওই দুইজন নিহত হয়।
এদিকে, বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুই জঙ্গি নুরুল ইসলাম মারজান ও সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে আরও একজন জঙ্গি ছিলেন। পুলিশ বলছে, তাঁদের সঙ্গে গোলাগুলির সময় ওই জঙ্গি পালিয়ে যান। জঙ্গিদের মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় হামলার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানিয়েছে পুলিশ।ঘটনার পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করে। ওই মামলার এজহারে এ কথা বলা হয়েছে। আজ শনিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী মামলা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলাটির বাদী ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক নম্বর টিমের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আজগর আলী।মামলার এজাহার বলছে, পুলিশ জানতে পারে, নব্য জেএমবির কয়েকজন সদস্য নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশে মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় জঙ্গি হামলা করতে পারেন। ওই এলাকায় গিয়ে ছদ্মবেশে পুলিশ অবস্থান নেয়। এরই মধ্যে খবর আসে, মোটরসাইকেলে করে জঙ্গিরা ওই এলাকা রেকি করতে বের হয়েছে। পুলিশ রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পাশে চেকপোস্ট বসায়।এজাহারে আরও বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আনুমানিক পৌনে তিনটার দিকে কালো রঙের মোটরসাইকেলে করে চালকসহ তিনজন আরোহী চেকপোস্টের কাছে আসেন। থামতে বললে তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে হ্যান্ড গ্রেনেড ও গুলি ছোড়েন। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। গোলাগুলির একপর্যায়ে মোটরসাইকেল আরোহী এক জঙ্গি পালিয়ে যান। দুই জঙ্গি মারজান ও সাদ্দাম নিহত হন।ঘটনাস্থল থেকে একটি ৭.৬৫ মিলিমিটার বিদেশি পিস্তল, একটি চাকু, দুটি গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন, বিস্ফোরিত দুটি গ্রেনেডের অংশবিশেষ, রেজিস্ট্রেশন নম্বরবিহীন টিভিএস স্টার মোটরসাইকেল ও কালো রঙের হেলমেট উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি সাদ্দাম হোসেন হাত গ্রেনেড তৈরিতে খুবই দক্ষ ছিল। গ্রেনেড তৈরিতে প্রশিক্ষণও দিতেন তিনি। এছাড়া গত বছর রাজধানীসহ সারাদেশে যেসব জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে তার বেশির ভাগই ছিল সাদ্দামের তৈরি।

শনিবার দুপুরে এসব তথ্য জানিয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র। গত বছর ১ জুলাই হলি আর্টিজানে নারকীয় হত্যাজজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। এ ঘটনা তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধান ও নব্য জেএমবি নেতাদের গোপন আলাপচারিতা থেকে এসব তথ্য পেয়েছে সিটিটিসি।গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আর্টিজান হামলার অপারেশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জঙ্গি নুরুল ইসলাম মারজানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ্দাম। সাদ্দাম হাত গ্রেনেড তৈরি করতেন এবং বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও দিতেন। গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও হাত গ্রেনেড মজুত রাখার ব্যবসা ছিল তার। এসব হাত গ্রেনেড দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেই পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি।সূত্র জানায়, গত বছর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ, নারায়ণগঞ্জ, কল্যাণপুর, সাভারের আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলে যে হাত গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল তার অধিকাংশই ছিল সাদ্দামের তৈরি। জেএমবির অন্যতম মাস্টার মাইন্ড তামিমের কথা উল্লেখ্য করে সূত্রটি জানায়, মাস্টার মাইন্ড তামিমের হাত ধরেই নব্য জেএমবিতে আসেন সাদ্দাম। গত বছর পহেলা ফেব্রুয়ারিতে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন তিনি। তার নামে একাধিক মামলা থাকলেও তাকে চিনতেন না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অচেনা মুখ হওয়ায় সুবাদে অনায়াসেই চলাফেরা করতেন সাদ্দাম। তবে, কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত হওয়ার পর সাদ্দামের খোঁজ পায় পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রযুক্তি ব্যবহারেও খুবই দক্ষ ছিল সাদ্দাম। নব্য জেএমবিতে আসার পর সংগঠনের প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রম দেখভাল করতেন। নব্য জেএমবির সদস্যরা শুধুমাত্র মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতেন। এছাড়া সবই ছিলে স্ব-শরীরে। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার চর বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম আনন্দ বাজারে সাদ্দামের বাড়ি। গ্রামের দরিদ্র কৃষক তাজুল আলমের সাত সন্তানের পঞ্চম সন্তান তিনি। স্ত্রী ফারজানার বাবার বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। শ্বশুর বাড়িতে থাকা অবস্থায় সাদ্দামকে ‘তুলে নিয়ে যায় পুলিশ’। এরপর থেকে তারা অনেক চেষ্টা করেও আর সাদ্দামের খোঁজ পায়নি। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার তিন মাস পর তার স্ত্রীর প্রথম ছেলে হয়। সন্তান হওয়ার পর থেকে সাদ্দামের স্ত্রী-সন্তানসহ তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন কোথায় চলে গেছে তা জানে না তার পরিবার।বৃহস্পতিবার (০৫ জানুয়ারি) গভীর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন সাদ্দাম। তার পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, ছোটবেলা থেকেই গ্রামে শান্ত, মার্জিত ও ভদ্র ছেলে বলে পরিচিত ছিলেন তিনি। দাখিল ও আলিম পাস করার পর লালমনিরহাট সরকারি কলেজে ইতিহাস বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হন। প্রথমবর্ষ পরীক্ষা দিলেও দ্বিতীয় বর্ষ থেকে আর কলেজে উপস্থিত ছিলেন না। ২০১৬ সালের ২২ মার্চ কুড়িগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়ায় জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যা, ১০ নভেম্বর রাতে কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চৈতার মোড়ে মাজার শরীফের খাদেম রহমত আলীকে (৬০) কুপিয়ে হত্যা এবং একই বছরের ৮ নভেম্বর বাহাই সম্প্রদায়ের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ও রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) রুহুল আমীনকে গুলি করে হত্যা চেষ্টা মামলার অভিযোগপত্র ভুক্ত আসামি সাদ্দাম হোসেন।